একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে কয়জন মুক্তিকামী তরুণ সিরাজগঞ্জ শহরের প্রতিরোধ যুদ্ধকে বেগবান করেছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দেওয়ান নজরুল। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী দৌলতপুর ও মালিপাড়া ক্যাম্প ও ৭নং কমান্ডিং রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ধীতপুরের টোপপাড়ার যুদ্ধে, কৈজুরীর যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পরই সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মমিন তালুকদারের সঙ্গে বেলকুচির এনায়েতপুরী পির সাহেবের মাজারের পূর্ব মাঠে একটি অনুষ্ঠানে এবং তার নিজ এলাকায় কৃষকগঞ্জ বাজারে ও নিজ গ্রাম শ্রীবাড়ীতে অনুষ্ঠান করার সময়ে একাত্তরের রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক দেওয়ান নজরুলই আজকের ম্যাপ বর্জিত জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দেওয়ান নজরুল সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের হাড়িভাঙ্গা শ্রীবাড়ী গ্রামে ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম দেওয়ান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দেওয়ান সাবের হোসেন। দাদা কালু দেওয়ান ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

দেওয়ান নজরুল স্থানীয় সলপের গোবিন্দপুর প্রাইমারী স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি, সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক স্বদেশ পত্রিকায়। তিনি উক্ত পত্রিকায় সিনে এডিটরের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জাতীয় দৈনিক সন্ধ্যা বার্তার বিভাগীয় সম্পাদক ও রিপোর্টার পত্রিকার ডিপ্লোমেটিক কলামিস্ট ছিলেন। তিনি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সিরাজগঞ্জের একজন নামকরা ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন এবং বি.এল হাই স্কুলের স্কাউট লিডার ছিলেন এবং আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে নিবিড়ভাবে কাজ করেন।

দেওয়ান নজরুল বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের অহংকার এবং চলচ্চিত্রের অতীত দিনে ফিরে তাকালে অনেক কিছু শেখা ও জানার ব্যাপারটা চলে আসে। অতীতের চলচ্চিত্রসমূহকে স্বর্ণযুগের ছবি বলা হয়ে থাকে। সেসময় নির্মাতারা একটি ছবির নির্মাণ নিয়ে ভাবতেন, গবেষণা করতেন এবং সর্বোপরি তাদের সর্বোচ্চ মেধার বিকাশ ঘটাতেন চলচ্চিত্রে। ফলশ্রুতিতে অতীতের চলচ্চিত্রসমূহ মানুষের মনে দাগ কাটে। স্বর্ণযুগের ছবির কথা, গান ও অভিনয় শিল্পীর কথা মনে উদিত হলে শিহরিত হয় সবাই। সেই দিনের চলচ্চিত্রের কথা মনে করলে যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখায় উঠে আসে তেমনি একজন সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান দেওয়ান নজরুল। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে যে কয়জন মেধাবী চিত্র পরিচালক রয়েছেন তাদের মাঝে অন্যতম। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তার রয়েছে একাধিক পরিচয়। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র প্রযোজক, কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্যকার, কবি, গীতিকার, সাংবাদিক। এছাড়াও তিনি একাত্তরের রণাঙ্গণের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

দেওয়ান নজরুল চলচ্চিত্রে আগমন করেন এদেশের সাড়া জাগানো ব্যবসা সফল ছবির পরিচালক সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান ইবনে মিজানের সহকারী হিসেবে ‘নাগিনীর প্রেম’ ছবিতে। পরে ইবনে মিজানের ‘ডাকু মনসুর’, ‘বাহাদুর’, ‘জিঘাংসা’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘দুই রাজকুমার’ ও ‘নিশান’ ছবিতে প্রধান সহকারী হিসেবে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৭৬ সালে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার পরিচালিত জ্যাম্বস প্রোডাক্টসন্সের ব্যানারে নির্মিত প্রথম ছবি ‘দোস্ত দুশমন’ সমগ্র দেশে এ্যাকশন ও ব্যবসা সফল ছবি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। দেওয়ান নজরুল এদেশের আধুনিক ও এ্যাকশন ছবির প্রবর্তক। তিনি এদেশে নতুন এ্যাকশন ছবির ধারা প্রবর্তন করেন। যাত্রা এবং নাটক থেকে চলচ্চিত্রকে সম্পূর্ণ আলাদা করে চলচ্চিত্রকে টেকনিক্যাল মানসম্মত করে চলচ্চিত্রে ছবি নির্মাণ করে ব্যাপকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের পরিবর্তন আনেন এবং নতুন ডায়মেনশনে বিগ ক্যানভাসে সোস্যাল এ্যাকশন ছবি নির্মাণ করেন। তিনি এ পর্যন্ত ১৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন। তার প্রায় সবগুলো ছবিই ব্যবসা সফল। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো হচ্ছে- ‘দোস্ত দুশমন’, ‘আসামী হাজির’, ‘বারুদ’, ‘ওস্তাদ সাগরেদ’, ‘জনি’, ‘কোরবানী’, ‘ধর্ম আমার মা’, ‘মাস্তান রাজা’, ‘কালিয়া’, ‘মাটির দুর্গ’, ‘আসমান জমিন’, এদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ তাঁর পরিচালিত ‘বাংলার নায়ক’ ছবিতে নায়ক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ‘সুজন বন্ধু’ এবং তার সর্বশেষ ছবি ‘দোজখ’। তিনি এদেশে প্রথম কাউবয় ছবি ‘আসামী হাজির’ নির্মাণ করেন। যে ছবিটি দেশব্যাপী সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোতে অভিনয় করে এদেশের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল রানা, ওয়াসিম এবং জসিম দেশ-বিদেশে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনিই প্রথম ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রামাণ্যচিত্র’ নির্মাণ করেন। যা চলচ্চিত্রে একটি ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

দেওয়ান নজরুল একজন জনপ্রিয় ও কালজয়ী গীতিকার। তাঁর প্রতিটি গান মিউজিক এবং অভিনয়ে সমৃদ্ধ করে সহজ ভাষায় চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করে মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে যা মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। তার লেখা গানগুলো এখনও শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনে থাকেন। তার চলচ্চিত্রে প্রথম লেখা গান (কে তুমি) ছায়াছবিতে কাজল রশিদের সুরে এবং সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে দিতাং দিতাং মাদল বাজে এবং এই ছবিতে আরেকটি কালজয়ী গান ‘বলে দাও মাটির পৃথিবী আমার কি অপরাধ’, ‘এক চোর যায় চলে মন চুরি করে পিছে লেগেছে দারোগা (প্রতিজ্ঞা) এই গানটি দিয়ে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী এন্ডু কিশোর প্রথম চলচ্চিত্রে দেওয়ান নজরুলের অনুপ্রেরণায় গান গেয়ে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তার আরও অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে যেমন- ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন’, ‘তুমি যে ডাকাত তুমি চোর’, ‘কেন আজ আমাকে এভাবে সাজালে’ (জিঘাংসা), ‘আজকে না হয় ভালোবাসো আর কোনদিন নয়’, ‘হেলেন ভেঙেছে ট্রয় নগরী দেখেছি কতজন ভেঙেছে কত মন সবই নারীর কারণ’, (মিন্টু আমার নাম), ‘কি যাদু আছে তোমারই চোখে জড়ালে আমায় তুমি ভালবাসাতে’, ‘ও সাগর কন্যারে কাঁচা সোনা গায়’, ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবনভরা অঙ্গে প্রেমের সুধা পান করে নাও, হায়রে আমার দিওয়ানা’ (বাহাদুর) ‘মিঠা লাগে যত ব্যথা দিসরে কালা’, ‘চুপি চুপি বল কেউ জেনে যাবে’, (নিশান) ‘চোর আমি ডাকু আমি বল নারে’, ‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও দাও ফুর্তি কর’ (জনি), ‘শোন ভাইয়েরা কথা শোন এমন একজন মানুষ আন’, ‘এরা পাবলিক ভাই চাইলে এরা মাথায় তুলে নেয়’, ‘তুই রূপের গৌরব করিস না রূপ চিরদিন থাকবে না’, ‘নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবিরে, এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এত যত্নে গড়াইয়েছেন সাঁই, (এক মুঠো ভাত), ‘আমার প্রিয়ার জন্য আমি সবকিছু পারি’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে’, (দোস্ত দুশমন), ‘ওগো তুমি যে রূপসী তোমারে ভালোবেসেছি কাছে এসে দূরে সরে যেও না’, (দুই রাজকুমার) রিজিয়া পারভীন দেওয়ান নজরুলের লেখা গান গেয়েই প্রথম চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন। ‘প্রেমের রেলগাড়ি দিকে দিকে চলে’, (লিনজা), বেবী নাজনীনের চলচ্চিত্রে প্রথম তার লেখা গান দিয়ে শুরু করেন। ‘প্রেমের জয় হোক’ (লিনজা), ‘স্বপ্ন দেখা রাজ কুমার মনে মনে তারে এঁকেছি’, (দুই রাজকুমার), ‘আল্লাহ আল্লাহ স্মরণ কর আমি পাপিরে দয়া কর’ (ধর্ম আমার মা), ‘আয়নার নয়নে দেখ আয়না আছে’ (গাদ্দার), ‘ঐ পাড়ার ছেলে সব বিদ্যালয়ে পড়ে ঐ পাড়ারই ন্যাংটা ছেলে ভিক্ষা কেন করে জবাব তোমায় দিতে হবে’ (চ্যালেঞ্জ), ‘বান্দা তুলেছে দুহাত কবুল কর মোনাজাত’ (প্রতিজ্ঞা), এই দুনিয়াতে যার কেউ নাই তার খোদা আছে’ (মাটির দুর্গ), ‘চোর চোর দুনিয়া চোরেরই কারখানা’, ‘হাসু আমায় ফাঁকি দিল মন দিল না কথা ছিল ঘর বাঁধবো সেতো হলো না’, ‘আমার পৃথিবী তুমি তোমার পৃথিবী আমি’ (আসামী হাজির) ‘ওগো তোমায় আমি ভালোবেসেছি’ (জিজ্ঞাসা), ‘জীবন থেকে জ্বলছি সৎ পথে চলছি বুকে নিয়ে ক্ষুধার জ্বালা আমি এক চটপটি ওয়ালা’ (মাস্তান রাজা), ‘ঝড় ঝড় উঠুক না পথ চলা থেমে যাবে না’ (লিনজা), ‘মাটি আমার মা আমি তোমার মতো হতে চাই’ (মাটির দুর্গ), ‘মানুষের এইতো জীবন জন্ম হলে হবে যে মরণ’ (কোরবানী), চ্যানেল একাত্তরের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে লেখেন ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর সারা বিশ্বের কাছে-ইতিহাস ইতিহাসে বাঙালি গৌরবের প্রশ্নের উত্তর একাত্তর একাত্তর একাত্তর’, দেওয়ান নজরুলের জীবনের একটি স্মরণীয় গান ‘একটি রাতের কবিতা তুমি হাজার রাতের কল্পনা’ (রেকর্ডকৃত)। তাঁর লেখা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ৭১’, ‘হৃদয়ের দরজা খুলে দাও-দাও’, ‘আমরা বাংলার মুক্তিযোদ্ধা’ ইত্যাদি গানের এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে প্রথম কাওয়ালি গান প্রবর্তন করেন। কাওয়ালি গানগুলো হচ্ছে ‘খাজা নিজাম ও খাজা গরিবে নেওয়াজ’ (দুই রাজকুমার)। তিনি চ্যানেল একাত্তরের সূচনা সংগীত- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর, সারা বিশ্বের কাছে-ইতিহাসে ইতিহাসে বাঙালি গৌরবের প্রশ্নের উত্তর একাত্তর একাত্তর একাত্তর লেখেন।

দেওয়ান নজরুলের লেখা অধিকাংশ গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন এদেশের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক মনসুর আহমেদ ও সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান ৫ বার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আলম খান। তাঁর লেখা অধিকাংশ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়না, সাবিনা ইয়াসমিন, খুরশিদ আলম ও এন্ড্রু কিশোর প্রমুখ।

দেওয়ান নজরুলের লেখা (জিঘাংসা) ছবির ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন’ দুই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মো. খুরশীদ আলম ও রুনা লায়লার এই গানটি রেডিও বাংলাদেশ থেকে এদেশের সর্বাধিক প্রচারিত গান হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে দেওয়ান নজরুল বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পুরস্কার লাভ করেন। এমনি প্রায় ২ হাজার কালজয়ী জনপ্রিয় গান লিখেছেন দেওয়ান নজরুল। তার পরিচালনায় ‘বারুদ’ ছবিটির বিজ্ঞাপন প্রথম টেলিভিশনে প্রচারিত হয় যে বিজ্ঞাপনটি দেওয়ান নজরুল নিজেই নির্মাণ করেছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ডায়নামিক এ্যাকশন ছবির প্রথম রূপকার হিসেবে দেওয়ান নজরুলের নাম এখনও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। এছাড়া ‘চুমকি চলেছে একা পথে সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে’ এই গানটি সুপার ডুপার হিট হিসেবে নতুন প্রজন্মরা গ্রহণ করেছে।

দেওয়ান নজরুল তাঁর মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সততাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োগ করেছেন। তাঁর আদর্শ ও প্রাণপণ প্রচেষ্টায় তিনি একজন মহান মানুষ ও চলচ্চিত্রের উন্নয়নের রূপকার হয়ে উঠেছেন। দেওয়ান নজরুল তাঁর কর্মদক্ষতা, পরিশ্রম, সততার মাধ্যমে নিজেকে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন বিজ্ঞ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গীতিকার হিসেবে। তিনি অতীতের সকল চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকেই ভালো ছবি ও দক্ষতার সাথে নির্মাণ করে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে হার মানিয়েছেন। তার চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন দেশবরেণ্য পরিচালক ইবনে মিজান ও চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক ভাষাসৈনিক আজিজ মেহের। এদের কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ।

প্রথিতযশা পরিচালক, প্রযোজক, কবি, সাংবাদিক, গীতিকার দেওয়ান নজরুল সিনে ফাইটার্স কাউন্সিলের সাংগঠনিক সম্পাদক, কসমোপলিটন ফ্রিডম ফাইটার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কালচারাল ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ফিল্ম ডাইরেক্টরস এসোসিয়েশনের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ফাউন্ডিং ফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ঢাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত বেস্ট অব মিডিয়ার পরিচালক, প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ডায়না ফিল্মস ইন্টারন্যাশনাল এর কর্ণধার ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় বিশেষ পারদর্শী।

দেওয়ান নজরুল চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা (বাচসাস) কর্তৃক আজীবন সম্মাননা পদকে ভূষিত হন এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় ২০০৫ সালে সিরাজগঞ্জ কৃতিজন সংবর্ধনাপ্রাপ্ত হন। এছাড়া তিনি জাতীয় পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।

দেওয়ান নজরুল ‘ফোকাস টেলিটাইম’-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে চ্যানেল ৭১ নামে একটি টিভি চ্যানেলের জন্য আবেদন করেছেন। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার জন্য তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্যোগ। তাঁর বয়স যখন ৯ বছর তখন থেকে তিনি কবিতা লেখেন। তার লেখা কবিতা ‘কিপ্টে বুড়ি’ ছড়া আকারে পাঠ্য বইতে স্থান পেয়েছে। তার লেখা উপন্যাস ‘মনখুশী’ এবং শিশুদের জন্য ‘হ থেকে হঠাৎ’ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা ‘এক পৃথিবী ভালোবাসা’ নামে একটি উন্নতমানের কবিতা বই প্রকাশিত হয়েছে। যা সাহিত্যাঙ্গনসহ সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। এছাড়াও ছোটোবেলায় সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশিত মাসিক যমুনা পত্রিকার তারার মেলা বিভাগে তার প্রথম কবিতা ‘মা’ প্রকাশিত হয়।

দেওয়ান নজরুল বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। যার চলচ্চিত্রে আসার পেছনে রয়েছে অনেক অজানা কথা। আর ছবি নির্মাণ ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও নাটকীয় ইতিহাস। তিনি চলচ্চিত্রে আগমন করেন এদেশের সাড়া জাগানো ব্যবসা সফল পরিচালক সিরাজগঞ্জের কৃতি সন্তান ইবনে মিজানের সহকারী হিসেবে ‘নাগিনীর প্রেম’ ছবিতে। পরে ইবনে মিজানের ‘ডাকু মনসুর’ ছবিটির প্রধান সহকারী পরিচালক হলেও সিংহভাগ কাজ দেওয়ান নজরুলই করেন। ছবির মাধ্যমে প্রযোজক শফিউর রহমান থেকে ‘শফি বিক্রমপুরী’ নাম ধারণ করেন। দেওয়ান নজরুল ছবির অপটিক্যাল টাইটেল করতে গিয়ে বিক্রমপুরী শব্দটি জুড়ে দেন। আজ অবধি তিনি ‘বিক্রমপুরী’ নামেই পরিচিত। জসিম এই ছবির মাধ্যমে পরিপূর্ণ ভিলেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ ছবির আগে জসিম একজন ফাইটার হিসেবে অভিনয় করতেন। দেওয়ান নজরুলের দেওয়া নাম ‘জ্যাম্বস’ প্রতিষ্ঠা হয় ডাকু মনসুর ছবি নির্মাণকালে। জসিমের ‘জে’, আমানের ‘এ’, মাহবুব খান গুই’-এর ‘এম’ এবং বাবুলের ‘বি’ চার বন্ধুর নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে জ্যাম্ব, পরে ওস্তাদ শফি বিক্রমপুরী (তারা ওস্তাদ বলতেন) ‘এস’ সংযুক্ত করে ‘জ্যাম্বস’ নামকরণ করা হয়। ডাকু মনসুর নির্মাণকালে এ রকম অনেক ঘটনার জন্ম হয়। যা আজ চলচ্চিত্রের পাতায় শুধু ইতিহাস।

ঢাকার চলচ্চিত্রে ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির সম্রাট নির্মাতা ইবনে মিজান ও প্রধান সহকারী দেওয়ান নজরুল ডাকু মনসুর ও জিঘাংসা ছবির সফল নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্রে ঝড় তোলেন। এরপর পরিকল্পনা করেন বিশাল আয়োজনে আরেকটি ছবি নির্মাণের। সিদ্ধান্ত নিলেন ইংরেজি উপন্যাস ‘করসিগান ব্রাদার্স’ অবলম্বনে ছবি নির্মাণ করবেন। এই উপন্যাস নিয়ে বোম্বেতে ‘গোড়া আউর কালে’ নামে একটি হিন্দি ছবি নির্মিত হয়। এই হিন্দি ছবিটিই বাংলায় নির্মাণ করেন পরিচালক ইবনে মিজান। নাম দিলেন ‘নিশান’। প্রযোজনা সংস্থা যমুনা ফিল্ম করপোরেশনের ব্যানারে নির্মিত ডাকু মনসুর (১৯৭৪)-এর বিপুল সাফল্যের পর রূপকথার জাদুঘর এবং ফ্যান্টাসি ছবির নির্মাতা ইবনে মিজান একই প্রযোজনা সংস্থা থেকে ‘বাহাদুর’ নামে একটি পোশাকি অ্যাকশন ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ছবিটির চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে বিশাল বাজেট নির্ধারিত হয়। পরিচালক ইবনে মিজান প্রথমে ছবিটি সিনেমাস্কোপে নির্মাণ করার চিন্তা-ভাবনা করলেও এফডিসির ক্যামেরা ও লেন্সের সমস্যার জন্য ৩৫ এমএম ক্যামেরায় নির্মাণের জন্য মনস্থির করেন। সে সময়ের সুপারস্টার ওয়াসিমকে ছবির নাম ভূমিকায় কাস্ট করেন। তার বিপরীতে সুঠাম দেহী, অপরূপ সুন্দরী অলিভিয়াকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেন। অলিভিয়া তখন এসএম শফির ‘দি রেইন’ ছবিতে অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। যেহেতু ছবিটি বিশাল বাজেটে নির্মিত হবে তাই সে সময় ঢাকার চলচ্চিত্রের সাড়া জাগানো রাফ এ্যান্ড টাফ জসিমকে ভিলেন চরিত্রে কাস্ট করেন। ছবিটি এফডিসি, বেঙ্গল স্টুডিও, মিরপুর সাভার এবং কক্সবাজারে সাগর সৈকতে অপরূপ লোকেশনে চিত্রায়ন করা হয়। বাহাদুর ছবির প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন দেওয়ান নজরুল। তিনি গীতিকার হিসেবেও সেসময় ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। দেওয়ান নজরুলের লেখা ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবনভরা অঙ্গে, প্রেমের সুধা পান করে নাও, হায়রে আমার দিওয়ানা’ গানটি দিয়ে এফডিসিতে বাহাদুর ছবির বিশাল আয়োজনে মহরত হয়। গানটিতে কণ্ঠ দেন সে সময়ের সাড়া জাগানো কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাসহ ২০ জন সহশিল্পী। সংগীত পরিচালক ছিলেন মনসুর আহমেদ এবং রেকর্ডিস্ট ছিলেন মালেক মনসুর। প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয় গানটি রেকর্ডিংয়ে, যা তৎকালীন অনেক বেশি। বেবিট্যাক্সিতে বসে লেখা গানটি দর্শকশ্রোতার হৃদয়ে গেঁথে আছে। এ ছবির আরেকটি জনপ্রিয় গানের জন্ম দেন দেওয়ান নজরুল ‘কি জাদু আছে তোমারও চোখে, জড়ালে আমায় তুমি ভালোবাসাতে’।

পরিচালক ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল সবসময় তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় অবাস্তব দৃশ্যগুলোকে ট্রিকস ফটোগ্রাফির মাধ্যমে পর্দায় উপস্থাপন করতেন। বাহাদুর ছবিতে জাদুমহল দৈত্যের হাতে নিয়ে যাওয়া তার কাজের নমুনা। এর মধ্যে কিছু ম্যাটওয়ার্ক করার জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন। বাহাদুর ছবিটি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ দেশের ট্রিকস ফটোগ্রাফির জনক হিসেবে ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুলের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ছবিটি ঢাকার আগে চট্টগ্রামে একযোগে পাঁচ হলে রিলিজ হয়। ‘গুলজার’ সিনেমা হলে প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে রাত বারোটার পরে (১২.০০-৩.০০) শো চালাতে হয় সাতদিন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই রেকর্ড আজও কোনো ছবি ভাঙতে পারেনি। এছাড়া এই ছবির গানগুলো একটানা ৭-৮ বছর রেডিওতে শ্রোতাদের অনুরোধে শোনানো হয়।

দেওয়ান নজরুলের একটি লেজি-অ্যাকশন ছবি জিঘাংসা। জিঘাংসা ছবিটি নিউ ডায়মেনশনে নির্মিত ছবি হিসেবে চলচ্চিত্রে পরিচিতি লাভ করে। তাছাড়া জিঘাংসা ছবিটি বাংলাদেশের প্রথম লেডি অ্যাকশন ছবি। তাই তার কিছু কিছু দৃশ্য ছেলে ডামি দিয়ে ক্যামেরাবন্দি করা হয়। এতো এ্যাকশন দৃশ্য আগের কোনো ছবিতে কেউ চিত্রায়ণ করেনি। এই ছবির টেকনিশিয়ানরা যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করে দৃশ্য গ্রহণ করেন। কারণ এটি ছিল একটি শক্তিশালী লেডি অ্যাকশন ছবি। ‘এক মুঠো ভাত’, স্বাধীনতা-উত্তরকালে চলচ্চিত্রের কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে থাকে। সে সময় ছিল অনেক দক্ষ ও মেধাবী পরিচালক, যাদের অনেকের নামেই ছবি হাউজফুল হতো তাদের মধ্যে দুজন নির্মাতার নাম উল্লেখ করা যায় তারা হলেন পরিচালক ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল। ফ্যান্টাসি কিংবা মডার্ন ফোক ফ্যান্টাসি ছবি নির্মাণে তার জুড়ি মেলা ভার। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালক ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল নির্মাণ করেন সোসাল এ্যাকশন ছবি ‘এক মুঠো ভাত’। ভিক্টর হুগোর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ অবলম্বনে হলিউডে একটি ছবি নির্মিত হয় এবং হিন্দিতে নির্মিত হয় ‘রুটি’ নামে একটি ছবি। ছবিটি সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ‘দুই রাজকুমার’ ও ‘নিশান’ ছবিতে প্রধান সহকারী হিসেবে দেওয়ান নজরুল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি পরিবর্তন এনে দেন পরিচালক দেওয়ান নজরুল। ছবি তৈরির নতুন ডায়মেনশনের সূচনা করেন। দেওয়ান নজরুলকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের এ্যাকশন ছবির জনক বলা হয়। তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের ক্যানভাসকে প্রসারিত করেন এবং চিত্রনাট্যে দ্রুততার জন্ম দেন। চলচ্চিত্র থেকে ফোর্সফিস চিত্রায়ন তুলে দিয়ে যাত্রা ও ড্রামা থেকে চলচ্চিত্রকে মুক্ত করেন। দোস্ত দুশমন দেওয়ান নজরুলের প্রথম পরিচালিত ছবি হলেও তার আগে তিনি পরিচালনার সুযোগ পান দুটি ছবির। ইসমাইল হোসেন প্রযোজিত সাইকা ফিল্মের ব্যানারে শুরু করেন ‘নাচে নাগিন বাজে বিন’। এফডিসিতে জাঁকজমকপূর্ণ গান মহরত হয়। মহরত উপলক্ষ্যে কয়েক মণ মিষ্টি বিতরণ করা হয়। কোনো কারণে ছবিটি নির্মিত হয় না। তারপর শুরু করেন আসামী হাজির ছবিটি। এরপর শুরু করেন দোস্ত দুশমন। এ ছবিটি নির্মাণের নেপথ্যে বলা যায় পরিচালক ইবনে মিজান ছিলেন তৎকালীন সময়ে সুপারহিট নির্মাতা। তার প্রধান সহকারী ছিলেন দেওয়ান নজরুল। তাছাড়া ব্যক্তিজীবনে ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল ছিলেন আপন মামাতো ফুফাতো ভাই। ইবনে মিজানের ছয়টি ছবিতে দেওয়ান নজরুল প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করেন। ইবনে মিজানের ছবিতে ফাইট ডিরেকশন দেন জসিম, আমান, বাবুল ও মাহবুব খান গুই-এর সম্মিলিত প্রয়াস জ্যাম্বস গ্রুপ। ফলে ইবনে মিজানের ছবিতে কাজ করার সুবাদে জ্যাম্বস গ্রুপের সঙ্গে দেওয়ান নজরুলের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। দেওয়ান নজরুলের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘দোস্ত দুশমন’ সমগ্র দেশে এ্যাকশন ও ব্যবসা সফল ছবি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। দোস্ত দুশমন দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবি। সত্তর দশকে নির্মিত এ ছবি তৈরি হয় যা চলচ্চিত্রের পাতায় ইতিহাস হয়ে রয়েছে। গাব্বার সিং-এর সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘ওরা কত জন ছিল রে কালু….খালি হাতে ফিরে এসেছিস… মনে করেছিস ওস্তাদ খুশি হবে’ জসিমের সুন্দর করে বলা ডায়ালগটি দর্শকশ্রোতাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ছবিটি সারাদেশে জসিমকে ভিলেন হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়।

ইবনে মিজানের প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে দেওয়ান নজরুল তখন তুঙ্গে। ইবনে মিজানের কয়েকটি ছবির শুটিংয়ের সূত্র ধরে ওয়াসিম, জসিম ও সোহেল রানার সঙ্গে দেওয়ান নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেওয়ান নজরুল মূলত সাংবাদিক থেকে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে পরিচালক ইবনে মিজান ও দেওয়ান নজরুল মামাতো-ফুফাতো ভাই যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনে মিজানের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে দেওয়ান নজরুল চলচ্চিত্রে নাটকীয় যাত্রা ফোর্সটি থেকে চলচ্চিত্রকে নতুন ধারায় আনার জন্য ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নে ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেন। একেবারে নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় ‘আসামী হাজির’ নামক একটি ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেন। বাইরের কোনো গল্পের অনুকরণ না করে ছবির পরিকল্পনা করেন এবং আসামী হাজির নির্মাণের মাধ্যমে দেওয়ান নজরুল পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি ‘কাশবন জলছবি’ প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে নির্মিত হয়। এটি দেওয়ান নজরুলের নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা।

উল্লেখ্য, ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির আগেই আসামী হাজির ছবির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু আসামী হাজির মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় তখন দোস্ত দুশমন ছবিটি আগে মুক্তি পায়। যা হোক আসামী হাজির ছবির পার্টনার প্রযোজক ছিলেন প্রয়াত প্রযোজক তাহের চৌধুরীর ছোটো ভাই পণ্ডিত। ওয়াসিম, জসিম, সোহেল রানা ও অলিভিয়া এ ছবির পাত্রপাত্রী ছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য অলিভিয়ার পরিবর্তে ববিতাকে নেওয়া হয়। মনসুর আহমেদের সংগীত পরিচালনায় সাবিনা ইয়াসমিন ও খুরশীদ আলমের দ্বৈতকণ্ঠের ‘প্রেম নগরের প্রেমিক আমি মজনু আমার নাম’ এই গানটি রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে দেওয়ান তার ওস্তাদ ইবনে মিজানকে দিয়ে মহরত উদ্বোধন করেন। ছবিটি মুক্তির পর বিপুল সাড়া ফেলে চলচ্চিত্রাঙ্গনে। দেশের অন্যান্য সিনেমা হলের সঙ্গে ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে সে সময় ছবিটি মুক্তি পায়। ছবির ব্যানার দেখে গুলিস্তান হলে হাজার হাজার দর্শক সমবেত হয়। দর্শকরা অতিষ্ঠ হয়ে হলের কলাপসিবল গেট ভেঙে প্রবেশ করে। ছবিটি দর্শকনন্দিত হয় এবং চলচ্চিত্রে নতুন ডায়মেনশন সৃষ্টি হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে দেওয়ান নজরুলের সহধর্মিণী মিসেস শাহীন নজরুল গানের জন্য সুকণ্ঠী গায়িকা, চলচ্চিত্রে একজন দক্ষ প্রযোজক, আর গৃহে অসম্ভব এক আদর্শবান সুগৃহিণী। তিনি ড্যান্সার মুভিজের স্বত্বাধিকারী। তাদের একমাত্র মেয়ে ন্যান্সি দেওয়ান। একমাত্র ছেলে সাদ্দাম দেওয়ান বিপ্লব।

দেওয়ান নজরুলের শ্বশুর ড. আবুল হোসেন লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে স্বনামধন্য এখঅঢঙ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

লেখক: মুঠোফোন: 01712-271120।