সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিস যেন দূর্নীতির আতুর ঘর। টাকা ছাড়া হচ্ছেনা জমির দলিল। আর উৎস করের নামে টাকা আদায় করে, তা চলে যাচ্ছে অফিসের একটি চক্রের হাতে। ভুক্তভোগী একজন আইন মন্ত্রনালয়ের সচিব বরাবর অভিযোগ দিলে বিষয়টি সম্মুখে আসে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমির মূল্য অনুযায়ী পে-অর্ডার করলেও, দলিলে লেখা হয় কম। আর তাতেই সন্দেহ হয় তার। আর সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংকের হিসাবে পে-অর্ডার নগদায়ন করার সংখ্যাও অনেক। রায়গঞ্জ সাব রেজিষ্টার অফিসের এই চক্রের সন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে আছে প্রতিদিন ৬০টাকা মজুরির উমেদার শাহাদৎ এর নাম। ইতিমধ্যেই তিন জনের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা। বিষটি খতিয়ে দেখে বাকীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস জেলা রেজিষ্টারের। বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি টেলিভিশন আর পত্রিকায় সংবাদ প্রচারের পর ভুক্তভোগীকে ফেরৎ দেয়া হয় টাকা আর তিনজনের বিরুদ্ধে নেয়া হয় সাময়িক ব্যবস্থা।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ সাব রেজিস্ট্রারে কার্যালয় যেন দূর্নীতির আতুর ঘরে পরিনত হয়েছে। টাকা ছারা হয় না কোন কাজ। উপজেলার মানুষ যে কোন কাজে গেলেই গুনতে হয় টাকা। জমি দলিল থেকে শুরু করে নকল উঠানো বা যে কোন ভুল সংশোধনী কিংবা পরামর্শ করতে গেলে প্রথমেই যেতে হবে উমেদার শাহাদৎ এর কাছে। যদি কেউ শাহাদৎকে বাদ দিয়ে অন্য কোন লোকের নিকট যায় তাহলে ঐ ব্যাক্তির কাজ হবেনা নিশ্চিত। পুরো সাব রেজিস্ট্রার অফিস শাহাদৎ এর নিয়ন্ত্রনে। আমরা অনুসন্ধানে খুজে বেরকরি কে এই শাহাদৎ ?

মো: শাহাদৎ হোসেন, পিতা : ইসমাঈল হোসেন, বাড়ী রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুড়কার চর। ২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বর রায়গঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের দৈনিক ৬০ টাকা মজুরিতে উমেদার পদে যোগদান করেন। সে সময় তার বাড়ীর ভিটা ছাড়া আর কোন সম্পদ ছিলোনা। দির্ঘ ১০ বছরে এই শাহাদতের আঙ্গুল ফুলে গলাগাছে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে বগুড়া শহরের শহরদিঘী মহল্লায় নিজ নামে ৪ ডিসিমাল ও তার স্ত্রী রত্না খাতুনের নামে ৬ ডিসিমাল জায়গা। ঘুড়কার চর গ্রামে তার নিজ নামে সারে ৬ বিঘা আবাদী জমি, ২টি পুকুর ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও বাৎসরিক মেয়াদী রয়েছে ২২ বিঘা আবাদী জমি। এই অঞ্চলে কেউ যদি জমি মেয়াদী রাখতে চায় তাহলে শাহাদৎ ছাড়া উপায় নাই। সকল জমি তার কাছেই মেয়াদী রাখতে হয়।

বগুড়ার শহরদিঘী মহল্লার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের এই শহরদিঘী মহল্লাটি শহরের বাহিরে হলেও এখানে এখন জমির মুল্য সর্বনিম্ন পাচলাখ টাকা ডিসিমাল। এখানে যে দুটি জায়গার কথা বলছেন সেটি সিরাজগঞ্জের রেষ্টার অফিসের এক কেরানী শাহাদৎ সাহেব কিনেছেন। সে এখানে বাড়ী করবেন বলে আমরা জানি।

ঘুড়কার চর গ্রামের মর্জিনা খাতুন বলেন, শাহাদৎ আমাদের গ্রামের ছেলে সে অনেক ভালো। আগে গরিব ছিলো এখন ভালো চাকরি করে। মেলা কয়ডো জমি কিনছে আবার কেউ জমি মেয়াদী রাখলে সে টাকা দিয়ে মেয়াদী রাখে। আল্লাহ দিলে এখন অনেক ভালো আছে।

ঘুড়কার চর গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাক্তি বলেন, শাহাদৎ ছেলে হিসেবে ভালোই তবে সে রেষ্টার অফিসে পিয়নের চাকরী করে আজ শুনলাম । আমরা জানি সে ঐ অফিসের কেরানী বাবু । তবে সে এখন অনেক কয়টা জমি জমা করেছে। অনেক জমি মেয়াদী রেখেছে। পুকুর আর গরুর খামার করে অনেক ভালোই আছে। তবে ৬০টাকা মজুরীর পিয়ন কিভাবে এতো কিছু করে তা তো বুঝে আছেনা । এই গ্রাম থেকে রায়গঞ্জ যেতে আসতেই তো ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাগে। এটা কেমনে সম্ভব।

মুলত: রায়গঞ্জের ক্ষিরতলা গ্রামের হাজী আসরাইল হোসেনের ছেলে মো: জাকির হোসেন জাকিরুল্লাহ তারা ৬ ভাই বোন। ওয়ারিশান সুত্রে পরিবারের ৬ জন জমিজমার মালিক হন তারা। সেটিই নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিতেই দ্বারস্থ্য হন রায়গঞ্জ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে। কথা বলেন সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের দৈনিক ৬০ টাকায় হাজিরার পিয়ন শাহাদতের সাথে। তিনিই দলিল লেখার জন্য নিয়ে যান দলিল লেখক রিজওয়ান রশিদের কাছে। রিজওয়ান রশিদ এই বন্টন নামা দলিলের জন্য সব মিলিয়ে জমির মূল্য দাড়ায় ৩ কোটি ১৪ লক্ষ ছেষট্টি হাজার টাকা। সাব রেজিষ্টার সাগর দাস, অফিস পিয়ন শাহাদৎ ও দলিল লেখক রিজওয়ানের পরামর্শে তৃতীয় পক্ষ আব্দুল মান্নানের মাধ্যমে সরকারী ফি বাবদ সোনালী ব্যাংক থেকে পে অর্ডার করেন ৩ লক্ষ ১৪ হাজার ৬শ ৩০ টাকার। সে মোতাবেক দলিল সম্পাদনও হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে দলিলের নকল তোলার পর। সেখানে উৎস করে জায়গায় ৩১৫৩০ টাকা লেখা থাকায় সন্দেহ করেন জাকির হোসেনের। পরের দিন জাকির হোসেন সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে গেলে কোন পাত্তা পায়না শাহাদৎ ও রেজওয়ানের কাছে। পরে সাংবাদিকদের সহযোগীতায় ব্যাংক স্টেস্টম্যান তুলে দেখাযায় তার পে-অডারের পুরো টাকা ক্যাশ করে তুলে নেয়া হয়েছে। সরকারের কোষাগারে জমা পরেনি একটি টাকাও। তখন তার পে-অডারের টাকার হদিস পাবার জন্য সহয্গোীতা চান সংবাদ কর্মীদের কাছে। আর অভিযোগ করেন আইন ও বিচার বিভাগ ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিবের কাছেও। সাব রেজিস্ট্রি অফিসের আইন অনুযায়ী ওয়ারিশায়ন বন্টন, দানপত্র দলিলে কোন উৎস করই দিতে হয়না। অথচো এই অফিসে সকল দলিলে নেয়া হয় উৎস কর। তাই সোনালী ব্যাংক থেকে গত এক মাসে সাব রেজিষ্ট্র অফিসের নামে ওয়ারিশায়ন বন্টন এবং দানপত্র দলিলে কোন উৎস করের পে অর্ডার ক্যাশ হয়েছে ১৬টি। যার মোট টাকার পরিমান ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৭০ টাকা। আর এভাবেই প্রতি মাসে এই অফিস থেকে ওয়ারিশায়ন বন্টন এবং দানপত্র দলিলের নামে নেয়া উৎস করের টাকা উত্তোলন করে বন্টন করে নেন এই চক্রটি। আর এই চক্রের প্রধান উমেদার শাহাদৎ ।

ভুক্তভোগী জাকির হোসেন জাকিরুল্লাহ বলেন, আপনারা এই দূর্নীতির সংবাদটি প্রচার করার পর সাব রেজিস্ট্রার সাহেব, শাহাদৎ, রেজওয়ান আর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি, সাধারন সম্পাদক মিলে আমাকে ২ লাখ ১০ টাকা ফেরৎ দিয়েছে। বাকী টাকা কবে দেবে আমি জানিনা। তারা আমাকে জেলা রেজিস্ট্রারের নিকট নিয়ে যায়। সেখানে আমার আর কোন অভিযোগ নেই মর্মে স্বাক্ষর নেয়। তারা আর কখনই এমন করবেনা বলে আমার কাছে কথা দেয়।

এই চক্রের মুলহোতা অফিস পিয়ন (উমেদার) শাহাদৎ বলেন, পে অর্ডারের পেছনে সাব রেজিষ্ট্রারের আর পে-অর্ডার কারীর স্বাক্ষর থাকে আমি এ সবের কিছুই জানিনা। আমাকে স্যার যে ভাবে বলে আমি সেই ভাবেই কাজ করি। এখানে অনেক কিছুই হয় সব কিছু আপনাদের বলতে পারবো না। আর আমার বগুড়াতে কোন জায়গা নেই। গ্রামের বাড়ীতে ২ বিঘা জায়গা আছে । একটা পুকুর আর কয়ডা গরু আছে। কয়েক বিঘা জমি মেয়াদী আছে। আমি অনেক কষ্ট করে চলি।

সিরাজগঞ্জ জেলা রেজিষ্টার মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আপনাদের সংবাদটি প্রচারের পর সত্যতা পেয়ে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। ইতিমধ্যেই নকল নোবিশকে বদলি করে তাড়াশ দিয়েছি, দলির লেখককে সাময়িক বরখাস্ত করেছি আর উমেদার শাহাদৎকে আমার অফিসে এনে বসিয়ে রেখেছি। সে প্রতিদিন আসবে সকাল ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত বসে থাকবে কোন কাজ করতে পারবেনা। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বাকীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে।