হরতাল। গুজরাটি এই শব্দটি এক সময় বাংলার মানুষের মুক্তির পথ তৈরির মোক্ষম হাতিয়ার হলেও এখন সাধারন মানুষের কাছে এক আতংকের নাম। খেটে খাওয়া, শ্রমজীবি, পেশাজীবি মানুষের কাছে হরতাল ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হলেও রাজনৈতিক চালবাজদের কাছে এখনো শব্দটির কদর রয়েছে। বিশেষ করে সরকার পরিচালনার শেষের দিকে বিরোধী দলের প্রধান অস্ত্র হিসেবে এটি যখন তখন ব্যবহার করা হয়। শব্দটি যেমন মধুর তেমনি বেদনাময়। যদি ক্ষমতায় থাকা যায় তাহলে হরতাল খুবই বাজে এক পন্থা বলে জনগনকে এর থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দেন সরকারি দলের নেতা-কর্মিরা। আর যারা ক্ষমতার বাইরে তারা হরতালের চেয়ে মিষ্টি তাল আর খুঁজে পাননা। কথায় কথায় দাবি আদায়ের ধূয়া তুলে একবার হরতালের ডাক দিলেই হলো। শুরু হয় এক শ্রেণির ভাগ্য সুপ্রসন্নকারি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ, আর সাথে কাঁচা কড়িতে জুটে যায় কিছু হুজুগে মানুষ। এই মানুষেরা কোন কিছু বোঝাপড়ার মধ্যে নেই। নেতার হুকুমে তাদের হাতের লাঠি ভাঙছে গাড়ি, ফাটছে মাথা, করছে অগ্নি সংযোগ। বোমা ফাটানো, ককটেল ফাটানো, লুটপাট, নৈরাজ্য সৃষ্টিসহ এমন কোন কাজ নেই যা হরতালের হুজুগে ও সুযোগে ঘটে না। হরতাল থামানোর কাজে সরকারের অস্ত্র হচ্ছে পুলিশ। তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে র‌্যাব, বিজিবি এমকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত মাঠে নামানো হয়। সরকারের এক কথা। দেশের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীকে হরতাল দমনে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় সরকারি দলের হরতাল প্রতিরোধক বাহিনীর এ্যাকশন। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। মার খায় সাধারন জনগণ। আর মার খাওয়াদের খোঁজ-খবর না নিলেও একটা খোঁজে তারা খুবই তৎপর। তা হলো মৃত ব্যক্তি কোন দল করেছে। দলের না হলেও দলে টানার চেষ্টা চলে সরকার-বিরোধীদল সবার মধ্যেই। এরপর মৃতের লাশ নিয়ে মিছিল-মিটিং, হরতাল চলতে থাকে সমান তালে। দেশের মানুষ হয়ে পড়ে জিম্মি। অসহায়, নিরীহ, মুটে-মজুর আর শ্রমিকদের কাজ বন্ধ হওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে তাদের দিন কাটে। অসহায় মানুষের দূর্গতি-দূর্ভোগ আর গুরুতর অসুস্থ রোগির অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছলেও কিছু যায় আসে না।
এমনি করে নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত সাধারন মানুষকে জিম্মি করে জান-মালের ক্ষতি করে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করে, অনেক তাজা রক্তের তপ্তস্রোত বইয়ে চলছে হরতাল হরতাল খেলা। ক্ষমতায় যাবার এই সিঁড়ি বেয়ে একদল উঠছে আর আরেক দল উঠার জন্য লম্ফঝম্ফ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাধারন জনগনের এই খেলায় কতটুকু সমর্থন আছে সে বিষয়টি নিয়ে ভাবার কেউ নেই। এমনকি সরকার এবং বিরোধীদল কেউই বাস্তব সত্যকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনা। নব্বইয়ের রক্তঝরা আন্দোলনের পর বিএনপি ক্ষমতায় যায়। এরপর আ’লীগের পাঁচ বছর। আবার সংঘাত শুরু। তত্বাবধায়কের আগমন সেই পথ ধরে। তারা এসে নির্বাচন দেবার নামে দুই দলের বাঘা বাঘা নেতাদের মুন্ডুপাত শুরু করে। দুই নেত্রী কারাগারের অভ্যন্তরে ঢুকতে বাধ্য হয়। অবশেষে নির্বাচন। এবার ক্ষমতায় আ’লীগ সরকার। তাদেরও চার বছর চলছে। এর মাঝে দুই দলই ক্ষমতার মসনদে যাবার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হতে না দিয়ে সাধারন মানুষকে জিম্মি করে হরতালের অনেক তাল গিলিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোন দলই নির্দিষ্ট মেয়াদের একদিন আগেও ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। অথচ এই সময়ে হরতালের তাল ঠিকমতো গিলতে না পেরে কতনা নিরীহ তাজা তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। তাদের এই অকাল-অনাকাক্সিক্ষত প্রয়াণের দায়ভার কেউ কি নিয়েছে? তাদের একটিরও কি বিচার সম্পন্ন হয়েছে? হয়েছে কারো শাস্তি? ইতিহাস বলছে না। হয়নি। এবং কখনো হবার সম্ভাবনা আদৌ আছে কি? আর দেশের যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দাতা সংস্থাসহ বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, এ বিষয়ে দুইদল চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছেন কি? কিংবা দেশের মানুষের জনদূর্ভোগের কথা একবারও কি তারা ভেবে দেখেছেন? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর সরকার বা বিরোধী দলের কাছে নেই।
ঠিক এ কারনেই একটা ভিন্ন প্রস্তাব সবিনয়ে নিবেদন করছি। মানতে হবে এমন জবরদস্তি নেই। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারটুকু সংবিধানে আছে বিধায় বিষয়ের অবতারণা। দেশের হরতাল রাজনীতির বিকল্প খোঁজার পরামর্শ আসছে সুশীল সমাজসহ বহু বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই প্রস্তাবের সাথে একটি প্রস্তাব যোগ করে বলতে চাই -যেহেতু হরতালের তালে ক্ষমতাসীন দল মেয়াদের আগে ক্ষমতা ছাড়েন নাই, যেহেতু হরতাল বিশ্বজিৎ, পুলিশ সার্জেন্ট ফরহাদ, বসুনিয়া, নুর হোসেনদের জীবন প্রদীপ চিরতরে নির্বাপিত করেছে, দেশকে বিদেশের কাছে হেয় করছে, মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, উৎপাদন ব্যাহত করছে, তাই এই বিকল্প কল্পনার অবতারণা। একটি সরকারের পাঁচ বছরের শাসনকালিন সময়ে বিরোধীদল হরতাল দিয়ে যতগুলো কর্মঘন্টা নষ্ট করবে ঠিক সমপরিমান সময় মূল শাসন সময়ের সঙ্গে যোগ হবে। ধরা যাক পাঁচ বছরে ৬০ দিন হরতাল হলো ,তাহলে সেই সরকারের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর দুইমাস। এভাবে যতদিন হরতাল হবে ততদিন যোগ হতে থাকবে। তবে দেশের প্রেক্ষাপট পুরো পাল্টে যেতে থাকলে, কিংবা দেশে বহিশত্রুর আক্রমন হলে অথবা এজাতীয় কোন অবস্থা হলে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। অথবা এক থেকে দুইবার হরতাল দেয়া যেতে পারে জনপ্রিয়তা প্রমাণের স্বার্থে। সেক্ষেত্রে হরতালে সরকার মাঠে নামাবেনা পুলিশ ,আর বিরোধীদল পিকেটিং করে কোন কিছুতে ভাংচুর চালাবে না। জনগণ যদি হরতালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় তবে সে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আর না হলে ওই সরকারের সময়ে আর একদিনও হরতাল ডাকা যাবে না। এরকম হলে বিরোধীদল আর হরতালের মতো ধংসাত্মক কর্মসূচি দেবে না। দেশ সংঘর্ষ-সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দাতা দেশগুলো আর নাক সিঁটকাতে পারবে না। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের চাকা সচল থাকবে। গণতন্ত্র ফিরে পাবে তার সুষ্ঠুধারা। জনগণ কাজের মূল্যায়ন করে পাঁচ বছর পরে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতায় বসাবে। সময় এসেছে নতুন চিন্তা-ধারার। আর এ চিন্তা আপামর মানুষের চিন্তায় রূপান্তরিত হোক। লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।