মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক দিনটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর। এই দিনে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার বরইতলা গ্রামে বর্বর পাকবাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। গণহত্যার শিকার হয়েছিল নারীসহ ১০৪ জন, আহত হয়েছিল অনেকে। পাক হানাদারদের দ্বারা সস্ত্রম হারিয়েছিল সদ্য বিবাহিতা ২ গৃহবধূ। আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পুরো বরইতলা গ্রাম। কৌশলগত কারণে ১৬ নভেম্বর রাতে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের ইব্রাহীম আলীর বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। রাতেই ওই গ্রামের এক রাজাকারের মাধ্যমে সংবাদটি পৌঁছে যায় কাজিপুর থানায় অবস্থান করা পাক হানাদারদের কাছে। ভোর হতে না হতেই পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। এ সময় পাহারারত ২ মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৩ হানাদার আহত হলে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে তারা। এ অবস্থায় কিছুটা অপ্র¯‘ত মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের পূর্বপ্রান্তের একটি নালার মধ্যে অবস্থান নিয়ে পাল্টা ফায়ার করতে থাকে। এসময় হানাদার বাহিনীর একটি অংশ গ্রামের কতিপয় রাজাকারের সহায়তায় পুরো গ্রামে হামলা চালায়। গণধর্ষণের শিকার হয় এ গ্রামেরই ২ গৃহবধূ। পাকহানাদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি গ্রামের মসজিদে আশ্রয় নেয়া ইদ্রিস আলী ও করিম বকস। তারা দুজনে নামাজ শেষে মসজিদে বসে কোরান শরিফ তেলায়াত করছিলেন। পাকসেনারা জুতা পায়ে মসজিদে ঢুকে তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসীকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে সন্দেহভাজন ২৭ ব্যক্তিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে জড়ো করে রাখা হয় গ্রামের ঠাকুরপাড়া এলাকায়।
এদিকে খবর পেয়ে এ অঞ্চলের কুড়ালিয়া, চিলগাছা, বাঐখোলা, গজারিয়া, হরিণাবাগবাটি গ্রামের কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দেন পাকহানাদারদের প্রতিরোধে। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত চলে বিরামহীন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাগণ সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক হ্যান্ডগ্রেনেড ব্যবহার করেন। এক পর্যায়ে বর্বর পাক হানাদাররা পিছু হটে। যাওয়ার সময় আটক ২৭ গ্রামবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ২৬ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়।
এ যুদ্ধে রবিলাল দাস, সোহরাব হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, চাঁন মিয়া, আব্দুল মজিদ, শাহজামাল, সুজাবত আলী, সোহরাব হোসেন, সোলায়মান হোসেন, আব্দুস ছামাদ, জমসের আলী, দেলসাদ আলী, ইজ্জত আলী, আব্দুল আজিজ নিহত হয়। অপরদিকে ৬ পাকসেনা ১ রাজাকার মারা যায়। হানাদারেরা গরুর গাড়িতে করে নিহত ৬ সেনার লাশ কাজিপুর থানায় নিয়ে যায়। রাতেই গ্রামবাসীরা মিলে যুদ্ধে নিহতদের দাফন করে। এই যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে ৫৯ জনের পরিচয় জানা গেছে। যুদ্ধ-পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে বরইতলায় নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে তাদের নাম পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।